মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ০৪:৩৪ অপরাহ্ন

খেসারত দিতে হচ্ছে যাত্রীদের

খেসারত দিতে হচ্ছে যাত্রীদের

স্বদেশ ডেস্ক:

টানা তিন দিনের ভোগান্তি। রাজধানী থেকে দেশের সব জেলায় সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন সড়ক পরিবহন ও লঞ্চ মালিক নেতারা। মানুষকে সীমাহীন কষ্ট দিয়ে তিন দিনের মাথায় গতকাল রবিবার বিকেলে ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নেয় সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি। এর পরপরই নৌ ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হয়। ফল দেশের সাধারণ মানুষের ওপর যাত্রীভাড়া বাবদ ৩১ ভাগ অতিরিক্ত ব্যয় চাপিয়ে দেওয়া হলো। তার পরও জিম্মিদশা কাটছে না। ট্রাক ধর্মঘট অব্যাহত রয়েছে।

গতকাল বিকেলে সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি ও বিআরটিএ বাসভাড়া নির্ধারণের বিষয়ে যৌথভাবে ঐকমত্যে পৌঁছে। ঘোষণা আসে ভাড়া বৃদ্ধির বিষয়ে। তাদের দেওয়া ঘোষণা অনুযায়ী, সড়ক পরিবহনে ভাড়া বাড়ল গড়ে ২৭ শতাংশ। অপরদিকে নৌ পরিবহনে ভাড়া বেড়েছে ৩৫ শতাংশ। গড়ে দুই খাত মিলে যাত্রীদের বাড়তি গুণতে হবে ৩১ ভাগের বেশি অর্থ। করোনা যেতে না যেতে দেশের মানুষের এই ক্রান্তিকালে তাদের ওপর ভাড়ার অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হলো।

গত শুক্রবার থেকে সারাদেশে পরিবহন ধর্মঘট শুরু হয়। ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদ করে শুরু করা এই ধর্মঘটে মানুষকে চরম বিপদে ফেলা হয়।

গতকাল সকালে রাজধানীর বনানীতে বিআরটিএ কার্যালয়ে যাত্রীবাহী বাসের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক শুরু হয়। টানা ৫ ঘণ্টা নানা দরকষাকষি শেষে গতকাল বিকালে ঘোষণা আসে- বাস-মিনিবাস চলবে। অন্যদিকে রাজধানীর মতিঝিলে বিআইডব্লিউটিএ কার্যালয়ে বৈঠক শুরু হয় গতকাল বিকালে। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়- সারাদেশে সব লঞ্চের ভাড়া ৩৫.২৯ শতাংশ বাড়নো হবে। সেই হিসাবে কিলোমিটারপ্রতি ভাড়া বাড়বে ৬০ পয়সা।

গতকাল বিকালে বাংলাদেশ লঞ্চ মালিক সমিতি এবং বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তারা। সেখানে ভাড়া বাড়ানোর বিষয়ে উভয় পক্ষের মতৈক্য হওয়ার পর লঞ্চ চলাচল শুরু করার ঘোষণা দেওয়া হয়। গতকাল রাত থেকে লঞ্চ চলাচল শুরুর খবরও

পাওয়া গেছে। বৈঠক শেষে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল সংস্থার সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকুর রহমান পাটোয়ারি বলেন, ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হওয়ার পর ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হয়েছে। এখন থেকে লঞ্চ চলবে।

বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে গত বুধবার রাতে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়িয়ে ৮০ টাকা নির্ধারণ করে সরকার। এর পর ভাড়া বাড়ানোর দাবিতে গত শুক্রবার অঘোষিতভাবে বাস, ট্রাক ও অন্যান্য পণ্যবাহী যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেন মালিকরা। পরে তাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে গতকাল শনিবার লঞ্চ চলাচলও বন্ধ করে দেন মালিকরা।

লঞ্চ ভাড়া ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত ১ টাকা ৭০ পয়সার পরিবর্তে ২ টাকা ৩০ পয়সা এবং ১০০ কিলোমিটারের ঊর্ধ্বে ১ টাকা ৪০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। জনপ্রতি সর্বনিম্ন ভাড়া ১৮ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৫ টাকা করা হয়েছে।

দেশে দূরপাল্লার বাস-মিনিবাসের ভাড়া গড়ে ২৭ শতাংশ বেড়েছে। পরিবহন নেতাদের ডাকা অঘোষিত ধর্মঘটের জেরে গতকাল বৈঠকে বসে ব্যয় বিশ্লেষণ কমিটি। বিআরটিএর চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন সংশ্লিষ্ট সংস্থাসহ পরিবহন খাতের শীর্ষ নেতারা। তাদের দাবির মুখে ভাড়া বাড়ানোর সুপারিশের ঘোষণা আসে বিকাল ৫টায়। এর পর সন্ধ্যার দিকে প্রজ্ঞাপন জারি করে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়।

গতকালের প্রজ্ঞাপনে আন্তঃজেলা ও দূরপাল্লার রুটে চলাচলকারী বাস ও মিনিবাসের ক্ষেত্রে প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া ১ টাকা ৪২ পয়সার পরিবর্তে নির্ধারণ করা হয় ১ টাকা ৮০ পয়সা। এ ছাড়া ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে প্রতি কিলোমিটারে বাসের ভাড়া ১ টাকা ৭০ পয়সার স্থলে ২ টাকা ১৫ পয়সা এবং মিনিবাসের ক্ষেত্রে ১ টাকা ৬০ পয়সার স্থলে ২ টাকা ৫ পয়সা নির্ধারণ করা হয়। আর বাস ও মিনিবাসের সর্বনিম্ন ভাড়া যথাক্রমে ৭ টাকার পরিবর্তে ১০ টাকা ও ৫ টাকার পরিবর্তে ৮ টাকা করা হয়। আর ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কো অর্ডিনেশন অথরিটির (ডিটিসিএ) আওতাধীন জেলা নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদী, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ ও ঢাকা জেলায় বাস ও মিনিবাস উভয় ক্ষেত্রে ভাড়া প্রতি কিলোমিটারে ১ টাকা ৬০ পয়সার স্থলে ২ টাকা ৫ পয়সা করা হয়। আজ ৮ নভেম্বর থেকে পুনর্নির্ধারিত ভাড়ার হার কার্যকর হবে।

এ বিষয়ে বিআরটিএর সাবেক চেয়ারম্যান আইয়ুবুর রহমান খান আমাদের সময়কে বলেন, ‘জ্বালানির দাম বৃদ্ধির সময় নৌপরিবহন এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ না করে দাম বাড়ানো হয়। ফলে মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হলো। আজ তিন দিন মানুষ ধর্মঘটের কারণে এ কষ্টের শিকার হলেন। যাত্রী পরিবহনে ভাড়া বাড়ল তাই ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা এলো। পণ্য পরিবহনের ধর্মঘট চলছেই। এতে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধিতে জীবনযাত্রার ব্যয় আরও অস্বাভাবিক হলো।’

তিনি আরও বলেন, ‘পরিবহন খাতে ভাড়া বাড়াতে ২১টি উপখাত রয়েছে। জ্বালানির দাম বৃদ্ধি এসব উপাদানের মধ্যে একটি। শুধু তেলের দাম নয়, সব কিছু ভাবতে হবে। যদি কিছুদিন পর আবার জ্বালানির দাম বাড়ে, তা হলে আবারও ভাড়া বাড়ানোর চাপ আসবে। অথচ অনেক উপাদান বিশ্লেষণ করে ভাড়া বাড়ানোর কথা। সুতরাং ভবিষ্যতে ভাড়া বাড়াতে হলে এসব বিষয় মাথায় রাখতে হবে। জ্বালানির দাম বাড়ানোর সময় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে ঘোষণা দেওয়া উচিত।’

গতকাল সকালে বনানীতে বিআরটিএর প্রধান কার্যালয়ের বৈঠকে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে প্রতি কিলোমিটারে ২ টাকা ৪৯ পয়সা দাবি করেন পরিবহন নেতারা। আর দূরপাল্লার রুটের জন্য তাদের দাবি ছিল ২ টাকা ৯ পয়সা। দর কষাকষির একপর্যায়ে সরকারের প্রস্তাবে রাজি হন পরিবহন নেতারা। যদিও তাদের এই সম্মতি নিয়েও শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে। কারণ গতকালের বৈঠকে বলা হয়েছে, সিটিং সার্ভিস বলতে কিছু নেই। সব বাহনের জন্য একই ভাড়া; কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে মহানগরীতে চলাচলরত অধিকাংশ বাস সিটিং সার্ভিস। তাই সরকারনির্ধারিত এই হার তারা কতটা মানবে, তা বলা মুশকিল। অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, পরিবহনকর্মীরা কখনো পুনর্নির্ধারিত ভাড়ার দ্বিগুণ অথবা তিনগুণ হারে ভাড়া আদায় করেন। এ নিয়ে যাত্রী ও পরিবহনকর্মীদের মধ্যে চলে বচসা। আরেকটি বিষয় হলো- বাসে ৫২ আসন বিবেচনা করে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়। দেখা যায় ৪০ আসন আর ৫২ আসনের মারপ্যাঁচ চলে। ফলে সুবিধা ভোগ করেন বাসমালিকরাই। তা ছাড়া সিএনজিচালিত বাসের ভাড়া বাড়েনি বলে গতকালের বৈঠকে জানানো হয়; কিন্তু সব বাহনই বর্ধিত হারে ভাড়া আদায়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এটি ঠেকানোর জন্য বিআরটিএর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার গতকাল বৈঠকে বলেছেন, ‘অতিরিক্ত ভাড়া আদায় এবং সিএনজিচালিত বাহনে বাড়তি ভাড়া নিলে ভ্রাম্যমাণ আদালত চলবে।’

গতকালের বৈঠক শেষে বিআরটিএর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার জানান, নতুন ভাড়া ৮ নভেম্বর (আজ) থেকে কার্যকর হবে। অন্যদিকে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েতুল্লাহ বলেন, ‘আমরা ধর্মঘট প্রত্যাহার করলাম।’

বলা হয়, পণ্য পরিবহনের ভাড়া সরকার ঠিক করে দেয় না। ফলে বনানীতে বিআরটিএ কার্যালয়ের বৈঠকে ট্রাক-কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির নেতারা ছিলেন না। ওই বৈঠক চলার মধ্যে বিকালে এ খাতসংশ্লিষ্ট মালিক সংগঠনগুলো জ্বালানি তেলের বর্ধিত মূল্য প্রত্যাহারের দাবিতে ধর্মঘট চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। রাজধানীর তেঁজগাওকেন্দ্রিক পণ্য পরিবহনে যুক্ত মালিকদের দুটি সংগঠন আছে। এর একটি বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ডভ্যান পণ্য পরিবহন মালিক সমিতি। গতকাল বিকালে এক সংবাদ সম্মেলনে ধর্মঘট চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন তারা। অপর সংগঠন বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ডভ্যান, ট্যাংক লরি ও প্রাইম মুভার মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ। সংগঠনের আহ্বায়ক রুস্তম আলী খান বলেছেন, তারা ধর্মঘট চালিয়ে যাবেন।

উল্লেখ্য, ব্যয় বিশ্লেষণ কমিটিতে আছেন বিআরটিএর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের যুগ্ম সচিব সৈয়দা ফারহানা কাউনাইন, বিআরটিএর পরিচালক (ইঞ্জি.) শীতাংশু শেখর বিশ্বাস, বিআরটিসির পরিচালক (প্রশাসন ও অপোরেশন) বিষ্ণু কুমার সরকার, আরপিজিসিএলের ডিজিএম মনোয়ারুল ইসলাম, ডিটিসিএর ডেপুটি ট্রান্সপোর্ট প্ল্যানার ধ্রুব আলম, সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সহসভাপতি আবুল কালাম, সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ, বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান রমেশ চন্দ্র ঘোষ, ক্যাবের ঢাকা জেলা কমিটির প্রেসিডেন্ট সামস এ খান এবং বিআরটিএর উপ-পরিচালক (ইঞ্জি-৩) বিমলেন্দু চাকমা।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877